Thursday, July 19, 2018

নজরুলের সুমধুর ছন্দে 'সেনানায়ক থেকে রাষ্ট্রশাসক'!

লেখক মুহাম্মদ আবু সাইদ। ১৭ হিজরী - ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফার খেলাফত চলমান। হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাসনকাল। শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট শোভা পাচ্ছিল মুসলমানদের শিরে।সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ইসলামের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে দিকের পর দিক। একের পর এক রাজ্য জয় করেই চলছে মুসলিম সৈন্যরা। ইসলামের বাস্তব পরিধি বেড়েই চলছে...! কারো মাঝে নেই নূন্যতম ক্লান্তি কিংবা বিশ্রাম ফুরসত। 'উন্নত মম শির' এঁর বাস্তব উদাহরণ প্রতিটি সৈনিক! এমন অকাতর পরিশ্রমী ক্লান্তিশূন্য ; শ্রান্তিহীন আদর্শবান সৈনিকদের সেনাধ্যক্ষ কে? কার নেতৃত্বে তাঁরা বিরামহীনভাবে পরপর বহু প্রবল শক্তিশালী অমুসলিম রাজ্যে শান্তির নীড় স্থাপন করছিল? কার অনন্য স্কন্ধে ছিল তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৈন্যদলের একক লিডারশীপ? যিঁনি ক্ষুদ্র-বৃহৎ শতাধিক যুদ্ধের বিজয়ী সেনাপতি, যাকে স্বয়ং রাসূলে খোদা উপাধি দিয়েছেন 'সাইফুল্লাহ্' সেই হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। অতিবাহিত হচ্ছে সেনাপতির জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। হযরত উমরের সময়কালে সিরিয়া-দামেশক-ফিহল-হিমস আর ইয়ারমুকের ময়দানে রোমানদের ঐতিহাসিক বিশাল সৈন্যদলের বিপক্ষে বীরবিক্রমে জয়ের পর মহাবীর খালিদ যেন টগবগে ফুটছেন। 'সাইফুল্লাহ্' এঁর বাস্তব প্রমাণ যেন দিচ্ছেন তিঁনি। শুধুমাত্র জাযিরাতুল আরব নয় বরং যত স্থানে মুসলমান আছে তত স্থানে 'সাইফুল্লাহ্' এঁর প্রশংসাবাণী প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হরদম চলছে খালিদের জিকির। তাঁর‌ই রেশ ধরে তৎকালীন খ্যাতনামা কবি আশ'‌আস রচনা করলেন সেনানায়কের প্রশংসায় বিশাল কাব্য। খালিদ বিন ওয়ালিদ শুনলেন। কবিতা পাঠ করলেন। তৃপ্তি পেলেন। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে পুরস্কৃত করলেন রচয়িতাকে। দশ হাজার দিরহাম প্রদানের মাধ্যমে। দিরহামের অঙ্ক দেখে কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়, সেনাপতি খালিদ কেমন খুশি হয়েছিল! স্বাভাবিকভাবেই চাপা র‌ইলো না এ কথা। আমিরুল মু'মিনীন এঁর কর্ণে প্রবেশ করল। বড় আশ্চর্যান্বিত হলেন। মর্মাহত‌ও বটে! তদন্তের নির্দেশ দিলেন। এত এত অর্থ তিঁনি কোথায় পেয়েছেন? কোন খাত থেকে খরচ করেছেন? তদন্তের মূল রিপোর্ট আসল। যদি সেনাপতি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ নিয়ে থাকেন তাহলে তিঁনি অবশ্যই অন্যায় করেছেন। আর যদি নিজ পকেট থেকে দিয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই তিঁনি অপচয় করেছেন। এই সামান্য সূত্র ধরে আমিরুল মু'মিনীন খালিদ বিন ওয়ালিদ-কে সেনাপতির মহান পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করলেন। মূলতঃ উনাকে পদচ্যুত করতে এটা আসল কারণ নয়। 'আল্লাহু ওয়া রাসূলুহু আ'লামু'! নতুন সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিলেন হযরত সা'দ ইবনে আবু উবায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে। পদচ্যুতির খবর শুনে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ এতটুকু বিচলিত হননি। কেহ তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জোড় গলায় বলেছিলেন, “আমি যুদ্ধ করি আল্লাহর জন্য ; উমরের জন্য নয়।” সেনাপতির পদ থেকে অব্যাহতির পর সাধারণ সেনা হিসেবে যুদ্ধের প্রতি আরও বেশী মনোযোগী হলেন। বীরত্ব যেন পূর্বের চেয়ে অনেকাংশে এগিয়ে! পরবর্তী যুদ্ধসমূহে সেনাপতি না হয়েও সেনাপতির চেয়ে কোনো অংশে কম ভূমিকা রাখেননি তিঁনি। জেরুজালেম-মিসর-দামেস্ক-‌আলেকজান্দ্রিয়া সহ সেনা হিসেবে প্রতিটি যুদ্ধে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেনা হয়েও যেন সেনাপতির মতোই লড়াই করছেন। যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ খালিদকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, তিঁনি অন্য সকলের মতো সাধারণ একজন সেনা! সেনাপতির পদ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কারণ দর্শানো ব্যতীত অপসারণের পর‌ও হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ এতটুকু বিচলিত হননি। কোনোরূপ প্রতিবাদ করার চেষ্টাও করেননি। আমিরুল মু'মিনীন এঁর আদেশ মেনে নিয়েছেন মাথা পেতে। নূন্যতম হেরফের করেননি! বরং পরবর্তীতে যুদ্ধের প্রতি আরও বেশী মনোযোগী হয়েছেন। নিষ্ঠার সাথে সেনাপতি সা'দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর অধীনে নিজের সর্বস্ব দিয়ে প্রাণপণে যুদ্ধ করেছেন। খলিফা হযরত উমর মহাবীর খালিদ এঁর এহেন শক্ত প্রশংসনীয় কর্ম দর্শনে মুগ্ধ হলেন। হলেন অনুতপ্ত‌ও। অতঃপর খলিফা সর্বত্র উদারচিত্তে ঘোষণা দিলেন, “আমি খালিদকে আস্থাহীনতা, ক্রোধবশতঃ বা এ জাতীয় কোন কারণে অপসারণ করিনি। শুধুমাত্র এ কারণে পদচ্যুত করেছি যে, মুসলমানরা জেনে নিক, খালিদের শক্তির ওপর ইসলামের বিজয়সমূহ নির্ভরশীল নয়। বরং ইসলামের বিজয় আল্লাহর মদদ ও সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ” সুবহান-‌আল্লাহ্! তৎপর খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর উপর পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে উনাকে সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োজিত করেন। বরাবরের মতোই খলিফার প্রতি আনুগত্যশীল হয়ে সাথে সাথে তিঁনি সিরিয়ার উদ্দেশ্যে র‌ওয়ানা হন। এভাবেই মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধের ময়দানের সেনাপতি থেকে রাষ্ট্রীয় শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। 'সাইফুল্লাহ্' খালিদ বিন ওয়ালিদ এঁর ইন্তেকালের পর হযরত উমর ফারুক বড্ড আফসোসের সাথে বলেছিলেন, “নারীরা খালিদের মতো সন্তান প্রসবে অক্ষম হয়ে গেছে!”
প্রিয় কবি নজরুল তাঁর সুমধুর ছন্দে বলেন, উমর যেদিন বিনা অজুহাতে পাঠাইল ফরমান, ‘সিপাহ-সালার খালেদ পাবে না পূর্বের সম্মান, আমার আদেশ - খালেদ ওলিদ সেনাপতি থাকিবে না, সা'দের অধীনে করিবে যুদ্ধ হয়ে সাধারণ সেনা!’ ঝড়া জলপাই - পাতার মতন কাঁপিতে কাঁপিতে সা'দ, দিল ফরমান, নফসি নফসি জপে, গণে পরমাদ! খালেদ! খালেদ! তাজিমের সাথে ফরমান পড়ে চুমি সিপা-সালারের সকল জেওর খুলিয়া ফেলিলে তুমি। শিশুর মতন সরল হাসিতে বদন উজালা করি একে একে সব রেখে দিলে তুমি সা'দের চরণ পরি! বলিলে, ‘আমি তো সেনাপতি হতে আসিনি, ইবনে সা'দ, সত্যের তরে হ‌ইব শহীদ, এই জীবনের সাধ! উমরের নয়, এ যে খলিফার ফরমান, ছি ছি আমি লঙ্ঘিয়া তাহা রোজ-কেয়ামতে হবো যশ-বদনামি?’ মার-মুখো যত সেনাদলে ডেকে ইঙ্গিতে বুঝাইলে, কুর্নিশ করি সা'দেরে, মামুলি সেনাবাসে ডেরা নিলে! সেনাদের চোখে আঁসু ধরে না কো, হেসে কেঁদে তারা বলে, ‘খালেদ আছিল মাথায় মোদের, এবার আসিল কোলে!’ মক্কায় যবে আসিলে ফিরিয়া, উমর কাঁদিয়া ছুটে, একি রে, খলিফা কাহার বক্ষে কাঁদিয়া পড়িল লুটে! ‘খালেদ! খালেদ!’ ডাকে আর কাঁদে উমর পাগল-প্রায়, বলে, ‘সত্যই মহাবীর তুই, বুসা দিই তোকে, আয়! তখ্‌তের পর তখ্‌ত যখন তোমার তেগের আগে ভাঙিতে লাগিলে, হাতুড়ি যেমন বাদামের খোসা ভাঙে, ভাবিলাম বুঝি তোমারে এবার মুগ্ধ আরব-বাসী সিজদা করিবে, বীরপূজা বুঝি আসিল সর্বনাশী! পরীক্ষা আমি করেছি খালেদ, ক্ষমা চাই ভাই ফের, আজ হতে তুমি সিপাহ-সালার ইসলাম জগতের!’

No comments:

Post a Comment

Featured post

কুরবানী বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ৬৫টি মাসআলা

 কোরবানী বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ৬৫টি মাসআলা ||-----๑▬▬๑﷽๑▬▬๑-----|| কোরবানী একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিময় আমল। আল্লাহ বলেন فصل لربك وانحر হে নবী! আপনি ...