মুহাম্মদ আবু সাইদ।
বলছিলাম ইসলাম বিদ্বেষীদের কথা। তাদের প্রবেশ পথ সম্পর্কে আগেই বলেছি। ইসলাম মানেই রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর নামে নাস্তিকতা কাজে ইসলাম বিদ্বেষীদের প্রধান এবং প্রথম টার্গেট ওখানেই।
"রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক বিবাহ করেছেন কেন? তিঁনি করলেন দশাধিক আর উম্মতকে দিলেন সর্বোচ্চ চারটি, অন্যায় নয় কি? তিঁনি কেমন চরিত্রবান ছিলেন যে পুত্রবধূকে বিবাহ করেছেন?" (নাউযুবিল্লাহ্)
রাসূলে খোদার বিবাহ সংক্রান্ত এমন আরও বহু সস্তা যৌক্তিকতার ভিত্তিতে কিছু প্রশ্ন তারা করে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ্, তাদের জবাবও আছে আমাদের নিকট। এখন শুধু জায়গা মতো সাহস করে পাল্টা জবাব দিতে হবে। বীর বাহাদুরের মতো চ্যালেঞ্জ ছুড়তে হবে। যেন তারা তাদের ভিত্তিহীন ভিটে মাটি নিয়ে কিছুটা হলেও শঙ্কিত হয়। এই 'কিছুটাই' হবে মোদের সাকসেস। চলুন, শুরু করা যাক!
[রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বারোটি বিবাহ্ মোবারক নিয়ে আলোচনা করব। তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রতিটি পর্বে চারটি করে বিবাহ্র পটভূমি এবং শিক্ষা নিয়ে আলোচনা থাকবে।]
১. হযরত খাদিজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা। ছিলেন বিধবা। মৃত স্বামীর উত্তরাধিকার সূত্রে খ্যাতনামা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। স্বভাব-চরিত্রে তৎকালীন আরবের সর্বোত্তম নারী। উপাধিও ছিল 'ত্বাহিরাহ্' - বিশুদ্ধ, পবিত্র। বলা হতো, খাদিজাতুত ত্বাহিরা। ব্যবসার সূত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে পরিচয়। ভালো লেগেছে। মনে ধরেছে। এমন ধরা ধরেনি কখনো পূর্বে! বিয়ের জন্য পয়গাম পাঠালেন রাসূলের দরবারে। অভিভাবক রূপে তখনও বিদ্যমান চাচাদের অনুমতি নিলেন। অতঃপর সানন্দে রাজি হলেন। বিবাহ্ মোবারক সম্পন্ন হলো। তখন মা খাদিজার বয়স ৪০ এবং রাসূলে আরাবীর মাত্র ২৫।
শিক্ষা: রূপ-লাবণ্য-যৌবন নয় বরং সৎ গুণে গুণান্বিত আদর্শবান নারীই হবে একজন পুরুষের পারফেক্ট জীবনসঙ্গিনী। পরবর্তী দীর্ঘ পঁচিশ বছরের সোনালী সংসারের দিকে তাকালেই ঠিক বুঝতে পারবেন, একজন সৎ গুণে গুণান্বিত আদর্শবান স্ত্রী, স্বামীর সফলতার পিছনে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সহায়িকার ভূমিকা পালন করে! হযরত পূর্বে এমনটা অনুভূত করেছিলেন বলেই পঁচিশ বছরের টগবগে যুবক হয়েও চল্লিশ বছরের বিধবা মহিলা মা খাদিজাতুল কুবরা-কে সানন্দে বিবাহ্ করেছিলেন। মূল কারণে সেই, 'সৎ, পবিত্র, আদর্শ'!
দ্বিতীয়তঃ মা খাদিজাতুল কুবরা-কে বিবাহ্ করার মাধ্যমে তাঁকে সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারী হিসেবে চিরসৌভাগ্যমণ্ডিত করলেন। সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারী - একজন নারী। নারীজাতির জন্য কতখানি গর্বের বিষয়, ভাবা যায়? একজন নারীর জন্য এঁর চেয়ে বড় গর্বের, ইজ্জত সম্মান আর মর্যাদার বিষয় কি হতে পারে? ইজ্জত সম্মানহীন অবহেলিত-উপেক্ষিত, নিপীড়িত নারীজাতিকে 'গর্বোজ্জ্বল নারীজাতি'-তে পরিণত করলেন। ইসলাম প্রদত্ত নারীজাতির সর্বোচ্চ মর্যাদাই যেন এটা!
২. হযরত সাওদা বিনতে জাময়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা। তিঁনি ইসলাম গ্রহণ করলেও তাঁর পিতা তখনও খ্রিষ্টান ছিলেন। হঠাৎ তাঁর স্বামীর মর্মান্তিক ইন্তেকাল। এমতাবস্থায় কি করবেন ভেবে কুল পাচ্ছিলেন না! কার কাছে যাবেন, কিভাবে বাকি জীবন অতিবাহিত করবেন তা নিয়েই সর্বক্ষণ পেরেশান। পিতা খ্রিষ্টান হওয়ায় পিতৃকুলে উঠতে পারছিলেন না। অপরদিকে রাসূলে খোদা মা খাদিজাতুল কুবরা-কে হারিয়ে নিঃস্ব, একা হয়ে পড়লেন। ঘরের সমস্ত কাজ একাই করতে লাগলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খালার সিদ্ধান্তে হযরত সাওদা বিনতে জাময়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা 'উম্মুল মু'মিনীন' এঁর মর্যাদায় সিক্ত হোন।
শিক্ষা: স্বামীর ইন্তেকালের পর স্বভাবতই একজন নারীর ঠাই হয় পিতৃকুল। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মান্তরিত হবার কারণে যখন একজন অসহায় নারী পিতৃকুলেও স্থান পাচ্ছে না তখন ঐ ধর্মের উপর কিংবা ঐ ধর্মাবলম্বী লোকদের উপর একটি দায়িত্ব এসে পড়ে না? অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানবতা আপনার ঘাড়ে কর্তব্য চাপিয়ে দিবে। আর সেখানে ধর্মীয় প্রধান হিসেবে, রাহমাতুল্লিল আলামীন রূপে আগত রাসূলে আরাবীর দায়িত্ব-কর্তব্য কিরূপ হওয়া চাই? কতটা ভারী হতে পারে বোঝা? ঠিক এ কর্তব্যপরায়ণের জায়গা থেকেই হযরত সাওদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে বিবাহ্ করা।
৩. হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা। হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রিয়তম কন্যা। সিদ্দিকে আকবর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পর সবচে বেশী ভালবাসেন যাকে সেই আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে হযরতের কদমে সোপর্দ করলেন। হযরত উৎফুল্লচিত্তে গ্রহণ করলেন। কিন্তু ঘরে তুললেন না। তখন মা আয়েশার বয়স দশের কোটাও পার হয়নি। অতঃপর হিজরত করলেন। হিজরতের কিছুদিন পর রাসূলে কারীম আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ব্যবস্থা করলেন। নিজের কাছে নিয়ে আসলেন। ঘরে তুললেন। তখন মা আয়েশার বয়স কিন্তু ঘরে তুললেন না। তখন মা আয়েশার বয়স দশের কোটাও পার হয়নি। অতঃপর হিজরত করলেন। হিজরতের কিছুদিন পর রাসূলে কারীম আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ব্যবস্থা করলেন। নিজের কাছে নিয়ে আসলেন। ঘরে তুললেন। তখন মা আয়েশার বয়স দশাধিক।
শিক্ষা: হিজরতের পূর্বে রাসূলে আরাবী আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে ঘরে তুলেননি। হিজরতের পরে মদিনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও রাহমাতুল্লিল আলামীন আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে মদিনায় নিজের কাছে নিয়ে আসার সমস্ত ব্যবস্থা করলেন। কেন? হযরত কি পারতেন না উনাকে মদিনায় রেখে দিতে? মক্কা তে দিব্যি ভালোই চলছিল। মদিনায় হিজরতের জরুরত কি ছিল? এই পয়েন্টে আছে আমাদের জন্য চরম শিক্ষা। স্ত্রীকে বেশীদিন দূরে রাখা যাবে না। কাছাকাছি থাকতে হবে। তুমি যেখানে বাস করবে সেখানে সাথে স্ত্রীর বাসেরও ব্যবস্থা করতে হবে। চাই তুমি যেখানেই যাও না কেন! তোমার উপর তোমার স্ত্রীর যথেষ্ট হক্ব আছে। হক্ব আদায় করার নিমিত্তে এবং স্ত্রীকে আপন বন্ধনে হেফাজত করতে তাকে কাছে নিয়ে আসো। এতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হওয়া চলবে না। রাসূলে খোদা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে মদিনায় হিজরতের মাধ্যমে ঘরে তুলে এই সূক্ষ্ম শিক্ষাটাই প্রেক্টিক্যাল দেখালেন উম্মতদেরকে। যেন কোনো অবস্থাতেই স্ত্রীর প্রতি কেহ গাফেল না হোন। অর্ধাঙ্গিনীর প্রতি সুবিচার করণে এঁর চেয়ে উত্তম উদাহরণ আর কি হতে পারে!
৪. হযরত হাফসা বিনতে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা। বদর যুদ্ধে উনার স্বামী আহত হয়ে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তিঁনি ঠাই পেলেন পিতৃকুল তথা হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নিকট। কিন্তু হযরত উমর উনার এই বিধবা কন্যার ভবিষ্যত নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়েন। হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নিকট বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে গেলে তিঁনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। হযরত আবু বকরও এ ব্যাপারে কিছু বলছেন না। এ নিয়ে ফারুকে আযম বিপাকে পড়ে যান। সারাক্ষণ টেনশনে থাকেন মেয়েকে নিয়ে। এমতাবস্থায় আসলেন দরবারে মোস্তফায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সমস্ত ব্যাপার খুলে বললেন। অতঃপর রাসূলে খোদা হযরত হাফসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-কে বিবাহ্ করতে সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেন। এতে হযরত উমর চিন্তামুক্ত হন। আর মাহবুবে খোদার ঘরে আপন কন্যাকে পাঠাতে পেরে ফারুকে আযম কতটা খুশি হয়েছেন সেটা জ্ঞানী পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন। আরেকটা সূক্ষ্ম বিষয় বুঝতে পেরেছেন? দরবারে মোস্তফা থেকে কেউ খালি হাতে ফিরে না। নৈরাশ হয় না। কিছু না কিছু মিলে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে অনেক সময় চাওয়ার চেয়ে পাওয়ার মাত্রাটা অত্যাধিক বেশী হয়। প্রমাণিত।
শিক্ষা: বদর যুদ্ধে আহত স্বামী কিছুদিন পর ইন্তেকাল করেছেন। ঠাই পেয়েছেন পিতৃকুলে। কিন্তু ভবিষ্যত অন্ধকার। বাবা প্রাণপণে চেষ্টা করছেন উপযুক্ত পাত্রের নিকট মেয়ের বিবাহের জন্য। কিন্তু বারংবার হতাশা নিয়েই ঘরে ফিরছেন। কার কাছে সপে দিবেন কন্যাকে? ভবিষ্যত জীবন কাটবে কিভাবে? এমতাবস্থায় আশ্রয়দাতার ভূমিকায় রাহমাতুল্লিল আলামীন। চিন্তিত বাবাকে চিন্তামুক্ত করলেন। হতাশাগ্রস্থ পিতাকে ভারমুক্ত করলেন। আশ্রয়হীন কন্যাকে আশ্রয় দিলেন। সম্বলহীন নারীকে ঘরে তুললেন। দাসীরূপে নয় ; স্ত্রীর মর্যাদা দানে। মানবতা বুঝি একেই বলে! 'রাহমাতুল্লিল আলামীন' এঁর রহমতের ঝলক দেখা গিয়েছিল খানিকটা। দরবারে মোস্তফায় চিন্তিত ব্যক্তি নিশ্চিন্ত হয়। হতাশাগ্রস্থ - প্রফুল্লিত হয়। নিরাশ্রয় - স্ব-সম্মানে আশ্রয় পায়। সম্বলহীন ব্যক্তির কিছু চাওয়ার থাকে না। সম্বলের বণ্টনই তো হচ্ছে সর্বক্ষণ!
একটু লক্ষ্য করুন! উল্লিখিত চারটি বিবাহের প্রতিটিতেই নারীর মর্যাদা নিহিত। প্রথমটিতে গুণ, আদর্শ। দ্বিতীয়তে নৈতিকতা, কর্তব্যবোধ। তৃতীয়তে সুবিচার, যথাযথ হক্ব আদায়। চতুর্থতে আশ্রয়, মানবতাবোধ।
আচ্ছা! যারা ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণার্থে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অধিক বিবাহের উপর বাঁকা আঙ্গুল তুলে তারাও কি এ শিক্ষণীয় বিষয়গুলো অস্বীকার করতে পারবে? যে নারীরা স্বার্থের মোহে পড়ে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করে তারা কি এ বিষয়সমূহ এড়িয়ে যেতে পারবে? চাইলেই কি এড়িয়ে চলা সম্ভব? তারাই তো এসবের ব্যানার লাগিয়ে নিজেদের দল ভারী করতে ব্যস্ত! আদতে তাদের কর্ণকুহরে এসব প্রবেশ করবে না কখনো। কারণ তারা বধির। কেমন বধির? ওয়া লাহুম আযানূন, লা ইয়াসমায়ুনা বিহা।(তারা শুনেও শুনে না) তাদের চোখ কখনো দেখবে না এ তৃপ্তিকর বিষয়গুলো। কারণ তারা অন্ধ। কেমন অন্ধ? ওয়া লাহুম আ'য়ূন, লা ইয়ূবচিরুনা বিহা। (তারা দেখেও দেখে না) তাদের মর্যাদা কত উচ্চস্তরের (!) জানেন? কাল আনয়াম ; বাল হুম আদ্বাল। (চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট) এসব বিষয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা মানে 'কানার হাতি দেখা'! তবুও যথাসম্ভব দায়িত্ব পালন করে যাই। যেন ধরা না খেতে হয়।
No comments:
Post a Comment