Thursday, July 26, 2018

শাহেনশাহে সিরিকোটি (রহঃ) নিজেই একটি কারামত !!!

শাহেনশাহে সিরিকোট রাঃ নিজেই একটি কারামত

☞ লেখক

ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী

আল্লাহর অলিগণের কারামত সত্য। অলিগণ নিজ নিজ কারামত গোপন রাখতে সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু আল্লাহ পাক কিছু কিছু কারামত প্রকাশ করে দেন। তা করেন অলিগণের শান ও মান সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য। চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া এমনই একটি প্রকাশিত কারামত। জিন্দা কারামত। যা নুহনবীর কিস্তিসম। যার আলোয় সমগ্র চট্টগ্রাম আলোকিত। সে আলো ঠিকরে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানেও ছড়িয়ে পড়েছে। 

আল্লাহর অলিগণ আল্লাহর ভালোবাসার ফেরিওয়ালা। আল্লাহ পাকের ৯৯টি সিফাতী নামের মধ্যে একটি মাত্র নাম কাহহার, মানে কঠোর, প্রতাপশালী। কাল হাশরের মাঠে তিনি হবেন কাহহার। বাকি ৯৮ টি সিফাতী বা গুণবাচক নামের সবগুলোই এই পৃথিবীবাসির জন্য। আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখি - পৃথিবীর অধিবাসী, জীবজন্তু, গাছপালা, তরুরাজি, গ্রহনক্ষত্র, আকাশ-জমিন এ সব কিছুতেই সেই মহান রবের ৯৮ নামের ছোঁয়া লেগে আছে। 


মানুষ আল্লাহ পাকের গুণে গুণান্বিত হয়ে উঠে। তবে রবের সমান হতে পারে না। এ জন্য কামালিয়তের যত চূড়াতেই কোনও মানুষ আরোহণ করুক না কেন, তিনি কখনোই মহান রবের সমতুল্য হতে পারেন না। মহান রব নিজ গুণে এবং নিজ কুদরতেই মহীয়ান। আর মানুষ সেই রব প্রদত্ত গুণে গুণান্বিত। মানুষের মধ্যে আল্লাহর নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ এবং মুমিনগণ সে গুণ বিলানোর ক্ষমতা রাখেন। সূর্য যেমন তার চারপাশের গ্রহরাজি এবং সৌরজগতের ভেতরের সবকিছুকে আলোকিত করতে পারে, আল্লাহর অলিগণও আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে চারপাশের মানুষকে আলোকিত করতে পারেন।


আল্লাহর তেমনি একজন আলোকিত অলি হলেন শাহেনশানে সিরিকোট সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু। তিনি ভালোবাসার ফেরিওয়ালা। যেখানেই তাঁর পদধূলি পড়েছে সেখানেই তিনি মানুষের মাঝে ভালোবাসা বিলিয়েছেন। কুরআন, হাদিস এবং ইলমের অন্যান্য শাখায় দক্ষতা অর্জনের পর তিনি আফ্রিকায় চলে গেলেন। সেখানে তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী। কিন্তু সাধারণ মানুষকে তিনি তাঁর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেন নি। সেখানে তিনি দু'হাত খুলে দান করেছেন। নিজ খরচে একটি মসজিদ তৈরি করেছেন যা আজো বিদ্যমান। 


আফ্রিকা জয়ের পর স্বদেশে ফিরে আসেন। তখন ১৯১২ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছর খানেক আগের ঘটনা। মহীয়সী এবং বিদুষী সহধর্মীনী হযরত সৈয়্যদা খাতুন (রহঃ)’র অনুপ্রেরণায় গাউসে জামান হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌরভী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)’র সান্নিধ্য লাভের আশায় হরিপুর গমন করেন। পথেই দেখা হয়ে যায় নূরানী চেহারার গাউসে জামানের সাথে। দু'জনের চোখাচোখি হতেই সালাম বিনিময় হলো। আল্লাহ্‌র এক অলি অন্য অলিকে দেখেই চিলে ফেললেন। খাজা চৌরভি রহঃ জিজ্ঞেস করলেন, "ওহে চাঁদপুরুষ, আপনি কোত্থেকে?" উত্তরে সিরিকোটি রহঃ বললেন, “গঙ্গর উপত্যাকা থেকে এসেছি। হরিপুর বাজারে একটি কাপড়ের দোকান দিয়েছি।”  


চৌরভী (রহঃ) বললেন, “আমার কাছে কিছু লোকজন আসে, আমি তাদেরকে বলবো যে, হরিপুর বাজারে আমার একটি কাপড়ের দোকান আছে, তারা যেন সেখানে যায়।” সুবহানআল্লাহ! দুয়েকটি কথাতেই মন জয় করে ফেললেন ভবিষ্যৎ খলিফার। সিরিকোটি রহঃ বুঝতে পারলেন এই মহান আউলিয়ার কথাই তাঁর প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণী বলেছিলেন। দুজনের দেখাসাক্ষাৎ চলতে থাকলো। বেশ অনেক বছর আপন মুরশিদের পদপানে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন। একজন খ্যাতনামা ব্যবসায়ী, আলেম, হাফেজ, ক্বারী অধিকন্তু নবী বংশের মর্যাদা সবকিছু ভুলে তিনি নিজের আমিত্ব বিনাশের এ কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজ মুর্শিদের মাধ্যমে আল্লাহ্ ও রাসূল ﷺ’র সন্তুষ্টি অর্জন করেন এবং ত্বরীকতের আসল পুরস্কার বেলায়ত ও খেলাফত লাভে ধন্য হন। এ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। আমরা আমিত্ব রোগে ভোগে থাকি।  


পীরের ইচ্ছেয় সিরিকোটি রহঃ এর পরবর্তী মিশন নির্ধারিত হলো বার্মার রেঙ্গুনে। সেখানেও মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার অসংখ্য নজীর স্থাপন করেন। সেখানে থাকতেই চৌরভি রহঃ রচিত "মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল" (দরূদ) প্রকাশের দায়িত্ব পান। ৩০ পারার দরূদের এ মহাকাব্য যিনি রচনা করেন তিনি জীবনে কোনও মাদ্রাসা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বারেও পা রাখার সুযোগ পাননি। মহান রবের মাধ্যমে ইলমে লাদুন্নির এক বিশাল ভাণ্ডার এ গ্রন্থ। 


১৯৪২ সালে সিরিকোটি রহঃ এর করা ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী জাপান কর্তৃক বোমা হামলায় রেঙ্গুন ধ্বংস হয়ে গেল। এর পূর্বেই তিনি তাঁর মুরিদদের সেখান থেকে হিজরত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। 


এরপর আবাদ হতে লাগলো মদিনাতুল আউলিয়া হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম। তিনি লক্ষ্য করলেন, ওখানকার মানুষ আল্লাহ্‌র অলিগণের মাধ্যমে ইসলামে দীক্ষিত হলেও কালের পরিক্রমায় সুন্নিয়ত থেকে তারা অনেক দূরে চলে গেছে। তাই তিনি সেখানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলেন। সেটা ছিল ১৯৫৪ সাল। যা কালক্রমে এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান “জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া" হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। 


"মুঝে দ্যাখনা হ্যায় তো মাদ্রাসা কো দ্যাখো", আল্লাহ্‌র অলির মুখ দিয়ে এই একটি কথার এতো ওজন যে, আজ পর্যন্ত এই মাদ্রাসা আলিশান একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এবং তা টিকে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। 


বিদায়ের ক্ষণটিও ছিল উল্লেখ করার মতো। আপন মুরশিদের মাধ্যমে তিনি পূর্ব থেকেই জানতে পেরেছিলেন যে একটি সন্তান তিনি লাভ করবেন যিনি মায়ের গর্ভে থাকতেই আল্লাহ্‌র অলি হিসেবে স্বীকৃত। তিনি আল্লামা হাফেয ক্বারী তৈয়ব শাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। ১৯৬১ সাল তথা ১৩৮০ হিজরীর পহেলা শাওয়াল ঈদুল ফিতর থেকে ১০ই জিলক্বদ রাত পর্যন্ত এই ৪০ দিন সিরিকোটি (রহঃ) একমাত্র লাচ্ছি ছাড়া অন্য কোন খাবার গ্রহণ করেননি। তাঁর চিরবিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এ চল্লিশ দিন তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে থাকেন সাহেবজাদা তৈয়্যব শাহ্ (রহঃ। প্রকৃতপক্ষে এ চল্লিশ দিনে সিরিকোটি (রহঃ) তৈয়্যব শাহ্ (রহঃ)’র হাতে গাউসিয়াতের মহান দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। এভাবে চল্লিশতম দিবস ১০ই জিলক্বদ বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে শাহেনশাহ সিরিকোটি (রহঃ) তাঁর শতোর্ধ্ব বছরের জাহেরী হায়াতের ইতি টানেন এবং পরদিন ১১ই জিলক্বদ জুমা দিবসে তাঁকে শায়িত করা হয়।

আজ তাঁর ৫৯তম ওফাত দিবস। এ বিশেষ দিনে আল্লাহ্‌র অলির উছীলায় মহান রবের কাছে আমাদের মাগফেরাতের আর্জি পেশ করছি। এই মহান গাউসকে আল্লাহ্‌ পাক জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।

No comments:

Post a Comment

Featured post

কুরবানী বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ৬৫টি মাসআলা

 কোরবানী বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ৬৫টি মাসআলা ||-----๑▬▬๑﷽๑▬▬๑-----|| কোরবানী একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিময় আমল। আল্লাহ বলেন فصل لربك وانحر হে নবী! আপনি ...